নবজাতকের নিউমোনিয়া, নবজাতকের ফুসফুসের সংক্রমণ, শিশুদের নিউমোনিয়ার লক্ষণ, শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিকার, নবজাতকের যত্ন, শিশুর শ্বাসকষ্ট, শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসা, নবজাতক সংক্রমণ, প্রি-ম্যাচিওর বেবি নিউমোনিয়া
নবজাতকের নিউমোনিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও সচেতনতা
নবজাতকের জন্য নিউমোনিয়া একটি গুরুতর ও সম্ভাব্য জীবনঘাতী সংক্রমণ। জন্মের পর প্রথম ২৮ দিনকে বলা হয় নবজাতক পর্যায়, আর এই সময় শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল থাকে। এই সময়কালে নিউমোনিয়ার মতো ফুসফুসের সংক্রমণ হলে তা দ্রুত জটিল রূপ নিতে পারে। তাই নবজাতকের নিউমোনিয়া সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নবজাতকের নিউমোনিয়া কী?
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের সংক্রমণ, যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকে। নবজাতকদের ক্ষেত্রে এটি মূলত ব্যাকটেরিয়াজনিত হয়ে থাকে। সংক্রমণের ফলে ফুসফুসে তরল বা পুঁজ জমে যায়, যা শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা সৃষ্টি করে।
নিউমোনিয়ার কারণসমূহ
নবজাতকের নিউমোনিয়া সাধারণত নিম্নোক্ত কারণে হয়ে থাকে:
১. প্রসবকালীন সংক্রমণ:
মায়ের জরায়ুতে থাকা অবস্থায় বা প্রসবের সময় শিশুর শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে নিউমোনিয়া হতে পারে।
২. জন্মের পরপরই সংক্রমণ:
শিশু যদি অপরিষ্কার পরিবেশে জন্ম নেয় বা প্রসব পরবর্তী পরিচর্যা ঠিকমতো না করা হয়, তখন সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৩. ভাইরাসজনিত সংক্রমণ:
কখনো কখনো ভাইরাসজনিত ইনফেকশন থেকেও নিউমোনিয়া হতে পারে। RSV (Respiratory Syncytial Virus) নবজাতকদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
৪. অকাল জন্ম (Preterm baby):
প্রি-ম্যাচিওর বা অকাল জন্ম নেওয়া শিশুরা নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকে কারণ তাদের ফুসফুস পুরোপুরি পরিপক্ব হয় না।
নিউমোনিয়ার লক্ষণসমূহ
নবজাতকদের নিউমোনিয়া অনেক সময় স্পষ্ট লক্ষণ ছাড়াই দেখা দেয়। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
দ্রুত ও কষ্টকর শ্বাস-প্রশ্বাস
নিঃশ্বাসে গ্রান বা শব্দ
বুকের মাঝখানে দেবে যাওয়া (Chest indrawing)
খাওয়াতে অক্ষমতা বা কম খাওয়া
অতিরিক্ত কাঁদা বা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া
শরীরে জ্বর বা হাইপোথার্মিয়া (অত্যধিক ঠান্ডা লাগা)
নীলাভ ঠোঁট বা হাত-পা (অক্সিজেনের ঘাটতি)
নিয়মিত ঘুম না হওয়া অথবা অতিরিক্ত ঘুম
নিউমোনিয়া শনাক্তকরণ (Diagnosis)
একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সাধারণত নিচের উপায়ে নিউমোনিয়া শনাক্ত করেন:
শারীরিক পরীক্ষা: শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস, বুকের আওয়াজ পর্যবেক্ষণ।
রক্ত পরীক্ষা: সংক্রমণের মাত্রা বোঝার জন্য।
এক্স-রে: ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা যায় কি না নিশ্চিত করতে।
অক্সিজেন স্যাচুরেশন টেস্ট (Pulse oximetry): শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন আছে কি না তা জানার জন্য।
চিকিৎসা ও প্রতিকার
নবজাতকের নিউমোনিয়া সময়মতো চিকিৎসা না করলে জটিলতা বাড়ে। সাধারণত চিকিৎসায় যা অন্তর্ভুক্ত হয়:
১. অ্যান্টিবায়োটিক:
ব্যাকটেরিয়াজনিত নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
২. অক্সিজেন থেরাপি:
শিশুর যদি অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, তবে তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়।
৩. ইনট্রাভেনাস (IV) ফ্লুইড:
শিশুর শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে স্যালাইন দেওয়া হয়।
৪. হাসপাতাল ভর্তি:
গুরুতর অবস্থায় শিশুদের NICU (Neonatal Intensive Care Unit)-তে ভর্তি করে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে করণীয়
সচেতনতা ও যত্নই নবজাতকের নিউমোনিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। কিছু কার্যকর পদক্ষেপ হলো:
✅ প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা
গর্ভাবস্থায় মায়ের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যা নবজাতকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
✅ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
শিশুর আশেপাশে থাকা ব্যক্তিদের হাত ধুয়ে শিশুকে ধরতে হবে। বাসার পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
✅ স্তন্যদুগ্ধ প্রদান
মায়ের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
✅ টিকাদান নিশ্চিত করা
BCG, Hib ও Pneumococcal টিকাগুলো শিশুকে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে।
✅ ধূমপানমুক্ত পরিবেশে রাখা
ধূমপানের ধোঁয়া শিশুর ফুসফুসে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। নবজাতককে সবসময় ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে রাখতে হবে।
গভীর সমস্যা বা জটিলতা হলে কী করবেন?
শিশু যদি খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নেয়, খাওয়াতে না পারে, শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় কিংবা চোখ উল্টে যেতে থাকে—তা হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অবহেলা করলে এটি সেপসিস, ব্রেইন ড্যামেজ কিংবা মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশে পরিস্থিতি ও সচেতনতা
বাংলাদেশে প্রতিবছর অনেক শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে যেখানে সচেতনতা কম এবং চিকিৎসা সুবিধা সীমিত। সরকারের ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টারগুলো এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
শেষ কথা: সচেতনতাই বাঁচাতে পারে জীবন
নবজাতকের নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য রোগ। তবে সময়মতো রোগ শনাক্ত না হলে এর ফলাফল হতে পারে মারাত্মক। তাই গর্ভাবস্থা থেকেই মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা, প্রসব-পরবর্তী পরিচর্যা, সময়মতো টিকা, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা এবং সন্তানের প্রতি নজরদারি—এই কিছু সহজ অভ্যাসই পারে একটি নবজাতককে নিউমোনিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে।
📌 পরামর্শ:
শিশুর যেকোনো অসুস্থতাকে ছোট করে দেখবেন না। দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করুন এবং আশেপাশের মা-বাবাদেরকেও সচেতন করুন।
মোঃ মাহমুদুর নবী ( আসলাম)
প্যারামেডিকেল, রেজিঃ নং-১৯৭৪৯৬
মেডিসিন,গাইনী, সার্জারি,মা ও শিশুর রোগ এবং ডেন্টাল মেডিসিনে অভিজ্ঞ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল টেকনোলজি এবং আলট্রাসনোগ্রাফি (বি মটু), রংপুর।