নবজাতকের বিভিন্ন রোগ ও প্রতিকার:
নবজাতকের জন্ম প্রতিটি পরিবারের জন্য এক পরম আনন্দের মুহূর্ত। তবে জন্মের পরপরই শিশুটির শরীর নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। এই সময়ে শিশুটি খুব সংবেদনশীল এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে জন্মের প্রথম মাসগুলোতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অনেক সময় এসব রোগ সঠিক সময়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা না পেলে মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে। এই ব্লগে আমরা নবজাতকের কিছু সাধারণ এবং গুরুতর রোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যার মাধ্যমে নতুন মা-বাবারা সচেতন হতে পারবেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
১. জন্ডিস (Neonatal Jaundice)
জন্ডিস নবজাতকের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা। জন্মের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৬০-৭০% শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয়।
লক্ষণ:
ত্বক ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া
অতিরিক্ত ঘুমানো বা খাওয়ার আগ্রহ কমে যাওয়া
প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া
কারণ: শিশুর রক্তে বিলিরুবিন নামক পদার্থের মাত্রা বেড়ে গেলে এটি হয়। অনেক ক্ষেত্রে এটি স্বাভাবিক ও সাময়িক, তবে মাত্রা বেশি হলে চিকিৎসা প্রয়োজন।
প্রতিকার:
হালকা রোদে রাখা
ফটোথেরাপি (বিশেষ ধরনের আলোতে চিকিৎসা)
গুরুতর হলে রক্ত পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে
২. নিউমোনিয়া (Pneumonia)
নবজাতকের নিউমোনিয়া একটি জীবনঘাতী সমস্যা হতে পারে। এটি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসজনিত হতে পারে।
লক্ষণ:
দ্রুত ও কষ্ট করে শ্বাস নেওয়া
ঠোঁট ও আঙুলে নীলাভ ভাব
জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া
খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া
কারণ: পরিবেশের ধুলাবালি, ঠান্ডা আবহাওয়া, অথবা মা থেকে সংক্রমণ হতে পারে।
প্রতিকার:
চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অ্যান্টিবায়োটিক
অক্সিজেন সাপোর্ট
প্রয়োজনে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (NICU) ভর্তি করা
৩. ডায়রিয়া (Neonatal Diarrhea)
নবজাতকের মধ্যে ডায়রিয়া একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর সমস্যা হতে পারে যদি তা ডিহাইড্রেশনের দিকে নিয়ে যায়।
লক্ষণ:
পাতলা ও ঘন ঘন পায়খানা
প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া
জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া
শিশুর অস্থিরতা বা দুর্বলতা
কারণ:
ভাইরাসজনিত সংক্রমণ (যেমন: রোটাভাইরাস)
দূষিত পানি বা দুধ
মায়ের স্তনের অপরিচ্ছন্নতা
প্রতিকার:
ওরস্যালাইন খাওয়ানো
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ
বুকের দুধ নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া
৪. সেপসিস (Neonatal Sepsis)
নবজাতকের সেপসিস একটি জটিল ইনফেকশন যা সময়মতো চিকিৎসা না হলে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
লক্ষণ:
জ্বর বা শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
খাওয়ার আগ্রহ না থাকা
খিঁচুনি বা ঝিম ধরা অবস্থা
নিঃশ্বাসে অস্বাভাবিকতা
কারণ: জন্মের সময় মা থেকে সংক্রমণ, অপারেশন বা নোংরা পরিবেশে প্রসব হলে সেপসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রতিকার:
হাসপাতাল ভর্তি
অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন
রক্ত পরীক্ষা করে কারণ নির্ধারণ
৫. রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম (RDS)
বিশেষ করে অপরিপক্ব (Premature) শিশুদের ফুসফুস পরিপূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়ায় শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
লক্ষণ:
হালকা নাক ডেকে শ্বাস নেওয়া
বুক ডেবে যাওয়া
নিঃশ্বাসের সময় কান্না
শরীরের রঙ নীলচে হওয়া
প্রতিকার:
NICU তে ভর্তি
অক্সিজেন ওয়ার্মার সাপোর্ট
প্রয়োজনে সার্ফ্যাকট্যান্ট থেরাপি
৬. চর্মরোগ (Skin Diseases)
নবজাতকের ত্বক খুবই সংবেদনশীল, ফলে বিভিন্ন চর্মরোগ দেখা দিতে পারে।
সাধারণ চর্মরোগ:
মিলিয়া (সাদা ছোট দানা)
ডায়াপার র্যাশ
নিউবর্ন একনে
ইরিথেমা টক্সিকাম
প্রতিকার:
ত্বক পরিষ্কার ও শুকনো রাখা
পেট্রোলিয়াম জেলি বা চিকিৎসকের পরামর্শে ক্রিম ব্যবহার
সাবান ও কেমিকেল এড়িয়ে চলা
৭. কোষ্ঠকাঠিন্য (Constipation)
নবজাতক দিনে ১-৩ বার পায়খানা করে। যদি দীর্ঘসময় না করে তবে কোষ্ঠকাঠিন্য ধরা পড়তে পারে।
লক্ষণ:
২-৩ দিন ধরে পায়খানা না হওয়া
পেট ফেঁপে যাওয়া
পায়খানার সময় কান্না করা
প্রতিকার:
শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো
চিকিৎসকের পরামর্শে হালকা গ্লিসারিন সাপোজিটরি
পেট হালকা ম্যাসাজ করা
৮. জন্মগত ত্রুটি (Congenital Disorders)
বাচ্চার জন্মের সময় কিছু জিনগত বা শারীরিক ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
উদাহরণ:
হৃদযন্ত্রে ছিদ্র (VSD, ASD)
ঠোঁট বা তালু কাটা
হাত-পায়ে গঠনগত সমস্যা
চিকিৎসা:
জন্মের পরপরই স্ক্যান ও পরীক্ষা
সময়মতো অস্ত্রোপচার
দীর্ঘমেয়াদী ফলোআপ ও থেরাপি
নবজাতকের সুস্থতার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
১. সম্পূর্ণ মাতৃদুগ্ধ পান করানো মায়ের দুধ শিশুর জন্য আদর্শ খাদ্য এবং এটি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা শিশুর পোশাক, বাসস্থান ও মা-বাবার হাত পরিষ্কার রাখা জরুরি।
৩. টিকাদান সময়মতো সম্পন্ন করা BCG, OPV, হেপাটাইটিস বি-সহ প্রাথমিক টিকা শিশুকে অনেক রোগ থেকে রক্ষা করে।
৪. প্রথম ৪৮ ঘণ্টা নজরদারি জন্মের পর কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা শিশু পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।
৫. চিকিৎসকের পরামর্শে চলুন নিজে ওষুধ না দিয়ে যে কোনো লক্ষণে চিকিৎসক দেখান।
নবজাতকের বিশেষ গুরুত্ব
নবজাতকের প্রথম মাসগুলো তার সারাজীবনের স্বাস্থ্যভিত্তি স্থাপন করে। এই সময়টিতে প্রতিটি মা-বাবার উচিত শিশুর প্রতি যত্নশীল ও সচেতন থাকা। যে রোগগুলোকে আমরা সাধারণ মনে করি, সেগুলো সময়মতো চিকিৎসা না পেলে বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। সঠিক যত্ন, পরিচ্ছন্নতা, এবং চিকিৎসা শিশুর সুস্থ ও নিরাপদ বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য।
মোঃ মাহমুদুর নবী ( আসলাম)
প্যারামেডিকেল, রেজিঃ নং-১৯৭৪৯৬
মেডিসিন,গাইনী, সার্জারি,মা ও শিশুর রোগ এবং ডেন্টাল মেডিসিনে অভিজ্ঞ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল টেকনোলজি এবং আলট্রাসনোগ্রাফি (বি মটু), রংপুর।