ভূমিকা
নবজাতক শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল থাকে। তাই তাদের যেকোনো সংক্রমণ সহজেই মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এদের মধ্যে হাম (Measles) একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ, যা সাধারণত ৬ মাস বা তার বেশি বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে নবজাতকও হামে আক্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে যদি মা গর্ভাবস্থায় টিকা না নিয়ে থাকেন বা শিশুর জন্মের পর সঠিক পরিচর্যা না করা হয়।
এই ব্লগে আমরা জানবো, হাম কীভাবে নবজাতকে আক্রান্ত করতে পারে, এর লক্ষণ কী, জটিলতা কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং কীভাবে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে নবজাতককে সুস্থ রাখা সম্ভব।
—
হাম কী?
হাম হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা Measles virus দ্বারা সৃষ্ট। এটি খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি, কাশি, কফ বা মুখের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে এটি বায়ুবাহিতভাবে ছড়ায়। এটি এতটাই সংক্রামক যে একজন আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কোনো ঘরে অবস্থান করেন, সেই ঘরে প্রবেশকারী প্রায় ৯০ শতাংশ অরক্ষিত মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
—
নবজাতকের হাম হওয়ার কারণ
সাধারণত জন্মের পর প্রথম ৪ থেকে ৬ মাস নবজাতক মায়ের শরীর থেকে পাওয়া অ্যান্টিবডির মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু যদি মা নিজে আগে হাম না করে থাকেন বা টিকা না নিয়ে থাকেন, তাহলে তার দুধে বা শরীরে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা গঠিত হয় না, যার ফলে নবজাতক ঝুঁকিতে পড়ে।
এছাড়া কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে নবজাতকের হাম হতে পারে:
অকাল জন্ম (Premature birth)
অপুষ্টি ও দুর্বলতা
অনুন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অপরিষ্কার পরিবেশ
হাম আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসা
—
নবজাতকের হাম-এর লক্ষণ
নবজাতকদের মধ্যে হাম চেনা তুলনামূলক কঠিন, কারণ অনেক সময় লক্ষণগুলো অস্পষ্ট হয়। তবে কিছু লক্ষণ দেখে সন্দেহ করা যেতে পারে:
১. উচ্চমাত্রার জ্বর
হাম শুরু হয় হঠাৎ জ্বর দিয়ে, যা ১০১°F থেকে ১০৪°F পর্যন্ত উঠতে পারে। অনেক সময় এই জ্বর ৩-৫ দিন স্থায়ী হয়।
২. চোখ লাল হওয়া ও পানি পড়া
নবজাতকের চোখ লাল হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত পানি পড়ে। মাঝে মাঝে আলো সহ্য করতে না পারার মতো অবস্থা হয়।
৩. শুকনো কাশি ও সর্দি
শিশুর নাক দিয়ে পানি পড়ে ও শুকনো কাশি হতে থাকে, যা সাধারণ ঠান্ডা জ্বরের মতো মনে হয়।
৪. মুখের ভেতরে সাদা দাগ (Koplik’s spots)
শিশুর মুখের ভেতরের গালের ভিতরের দিকে ছোট ছোট সাদা দানা দেখা যায়। এটি হাম রোগের একটি নির্দিষ্ট লক্ষণ।
৫. লালচে র্যাশ বা ফুসকুড়ি
জ্বর শুরুর ৩-৫ দিনের মধ্যে নবজাতকের মুখে, গলায়, তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে লালচে ফুসকুড়ি দেখা যায়।
—
হাম-এর জটিলতা
নবজাতকের শরীর দুর্বল হওয়ায় হাম খুব সহজেই নানা মারাত্মক জটিলতায় পরিণত হতে পারে:
✅ নিউমোনিয়া
হাম আক্রান্ত নবজাতকের ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে নিউমোনিয়া হয়। এটি হামজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ।
✅ ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতা
হামের কারণে অনেক সময় ডায়রিয়া দেখা দেয়। এটি শিশুদের শরীরে অতিরিক্ত পানি ও লবণক্ষয়ের কারণ হয়।
✅ কান পাকা বা মধ্যকর্ণে সংক্রমণ
মাঝেমধ্যে হাম শিশুর কানে সংক্রমণ ঘটায়, যার ফলে তারা কান পাকা সমস্যায় ভোগে।
✅ মস্তিষ্কের প্রদাহ (Encephalitis)
হামের মারাত্মক জটিলতা হলো এনসেফালাইটিস, যা খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
✅ অপুষ্টি
হামে আক্রান্ত শিশুর খাওয়া-দাওয়া কমে যাওয়ার ফলে তারা সহজেই অপুষ্টির শিকার হয়, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।
—
করণীয় ও চিকিৎসা
হামের কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। তবে লক্ষণ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যার মাধ্যমে জটিলতা কমানো যায়।
🔹 চিকিৎসকের পরামর্শ
যেকোনো সন্দেহজনক লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
🔹 পর্যাপ্ত বুকের দুধ
শিশুকে বেশি করে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং পানিশূন্যতা কমে।
🔹 জ্বর নিয়ন্ত্রণ
জ্বর বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
🔹 পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
শিশুর চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কাপড়, বিছানা, খেলনা নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
🔹 পর্যাপ্ত বিশ্রাম
শিশুকে আলো কম এমন শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম নিতে দিতে হবে।
—
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
হাম প্রতিরোধযোগ্য রোগ। কিছু সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে নবজাতকের এই রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়:
✅ MR টিকাদান
৯ মাস বয়সে শিশুকে MR টিকা (Measles-Rubella) দিতে হবে। তবে গর্ভবতী মাকে গর্ভধারণের আগে এই টিকা নেওয়া জরুরি।
✅ মাতৃ স্বাস্থ্যের যত্ন
গর্ভাবস্থায় মা যদি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করেন এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করান, তবে নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
✅ ভিড় এড়িয়ে চলা
নবজাতককে গণপরিবহন, বাজার বা হাসপাতালের মতো জায়গায় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
—
নবজাতকের পরিবারের প্রতি পরামর্শ
নবজাতকের হাম একটি গুরুতর এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেলে প্রাণঘাতী রোগে পরিণত হতে পারে। তাই শিশুর যেকোনো অস্বাভাবিক লক্ষণে দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। সেই সঙ্গে টিকাদান ও মায়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা এই রোগ প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা রাখে।
আপনার একটি সচেতন সিদ্ধান্তই পারে একটি শিশুর জীবন বাঁচাতে।
মোঃ মাহমুদুর নবী ( আসলাম)
প্যারামেডিকেল, রেজিঃ নং-১৯৭৪৯৬
মেডিসিন,গাইনী, সার্জারি,মা ও শিশুর রোগ এবং ডেন্টাল মেডিসিনে অভিজ্ঞ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল টেকনোলজি এবং আলট্রাসনোগ্রাফি (বি মটু), রংপুর।